
চিম্বুক পাহাড়, শঙ্খ নদ, নীলগিরি আর বগা লেকের অপার সৌন্দর্য মেয়েটিকে আনমনা করে তুলত। আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমানো পাহাড়ের কোলে শুয়ে স্বপ্ন দেখতেন অনেক বড় হবেন। কত বড় হবেন বান্দরবানের লামার মেয়ে জ উ প্রু, সেটা এখনো অজানা। তবে বড় হওয়ার সিঁড়িতে পা রেখেছেন বছর দুয়েক আগে, এসএ গেমসে দুটি সোনার পদক জিতে।
মারামারির খেলা কারাতে নয়, ভালোবাসতেন সাঁতার। কিন্তু সাঁতার ছেড়ে কারাতের দিকেই ঝুঁকে পড়লেন জ উ প্রু। বয়স তখন মাত্র সাত বছর। আর্থিক অনটনে পড়ে বাবা-মা তাকে পাঠিয়ে দিলেন আশ্রমে। লামার মহামনি শিশু সদনে বেড়ে ওঠা। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও দারুণ আগ্রহী জ উ প্রুর সঙ্গে একদিন পরিচয় হয় সদর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বাবু যোশেলার। বলতে গেলে তিনিই খুলেদেন করাতে দুনিয়ায় প্রবেশের দ্বার।
বান্দরবান থেকে ঢাকায় জাতীয় প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ মেলে জ উর। তখন জুডো ও কারাতে এক সঙ্গে খেলা হতো। প্রথম বছরেই শিশু-কিশোরদের প্রতিযোগিতায় সোনা। জ উর এমন সাফল্য দেখে মহামনি শিশু সদনের প্রধান শিক্ষক সুইং ম তো মহা খুশি। বেশ যত্ন নিয়ে কারাতে শেখানোর দায়িত্ব নিলেন তিনি। জাতীয় প্রতিযোগিতার জন্য চলল কঠোর অনুশীলন। ১৯৯৭ সালে প্রথম এলেন জাতীয় কারাতেতে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রতিবারই কারাতের কাতা ইভেন্টের সোনার পদকটা তাঁর জন্য বরাদ্দ। জাপান কাপ, মোহামেডান কাপসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় টুর্নামেন্ট মিলিয়ে সোনা জিতেছেন ৯৭টি। জ উ প্রু শো-কেস ভর্তি পদক দেখেন আর হাসেন।
ঢাকায় সর্বশেষ এসএ গেমসে দলীয় ও ব্যক্তিগত দুটি ইভেন্টেই জিতলেন সোনা। অথচ এই এসএ গেমসের ক্যাম্পে তাঁকে নিতেই চাইছিলেন না ফেডারেশন কর্মকর্তারা। দেড় বছরের ছেলে সিং জ উকে নিয়ে ক্যাম্পে থাকতে পারবে না, ‘ঝামেলা’র অজুহাতে তাই তাঁকে এড়াতে চাওয়া। কিন্তু ভাগ্যদেবী যে তাঁর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন! আরেক প্রতিযোগী মুন্নি খানম হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ায় সুযোগ মিলল জ উ প্রুর। শাশুড়িকে ক্যাম্পে নিজের কাছে রেখে দিলেন ছেলেকে দেখাশোনার জন্য। সোনা জিতে সবাইকে দেখিয়ে দিলেন, ‘আমিও পারি।’ এসএ গেমসে দুটি সোনাই তাঁকে এনে দিয়েছে গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদ হওয়ার গৌরব। পুরস্কার নিতে গিয়ে বলছিলেন, ‘এই ছেলেকে নিয়ে আমি অনেক কষ্ট করেছি অনুশীলনে। কষ্ট হলেও আমি দেশের স্বার্থে, দেশের পতাকার জন্য অনুশীলন করেছি।’
স্বামী সিং ম, ছেলে সিং জ এবং মেয়ে তাজাং প্রুকে নিয়ে বান্দরবানেই দিন কাটছে জ উর। অনুশীলন কিন্তু থেমে নেই। স্বামী কারাতে প্রশিক্ষক হওয়াতে সুবিধাই হয়েছে। লামায় ইউনাইটেড ক্লাবের পরিচালক সিং ম। সেখানেই নিয়মিত অনুশীলন করে চলেছেন জ উ আর স্বপ্নের জাল বুনছেন, ‘স্বপ্ন দেখি এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমসের মতো আসরেও পদক জেতার। অসম্ভব বলে কিছু নেই। কারাতেতে তো আগে এসএ গেমসে পদক জেতার কথা ভাবারও সাহস পেত না কেউ।’
দারুণ শর্ষে ইলিশ রাঁধতে পারেন জ উ। বাঙালিয়ানার চেয়ে নিজেদের উপজাতীয় পোশাক থানেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। প্রিয় রং আকাশি নীল। মনটা উদাস হয়ে গেলে পাহাড়ের ঢালে বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন। আকাশছোঁয়া পাহাড়ের উচ্চতায় যে একদিন আবিষ্কার করতে চান নিজেকে!